Skip to main content

দৃষ্টিনন্দন সম্পুর্ণ কাঠের তৈরি মমিন মসজিদ


কাঠের তৈরি সবচেয়ে প্রাচীন ও ছোট আকৃতির মসজিদের একক নিদর্শন 'মমিন মসজিদ'। মসজিদটি এখন দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, বিশ্বেরই একমাত্র কাঠের তৈরি দৃষ্টিনন্দন মুসলিম স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন।আর এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন বরিশাল অঞ্চলের পিরোজপুরের ধর্মপ্রাণ যুবক মৌলভী মমিন উদ্দিন আকন।

মমিন মসজিদের পেছনের গল্প:

বুড়িরচর গ্রামের সম্ভ্রান্ত আকন বাড়ির মৌলভী মমিন উদ্দিন আকন অনন্যসুন্দর এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তবে মমিন মসজিদের প্রতিষ্ঠা নিয়ে দুই রকম তথ্য পাওয়া যায়।
১৯০০ সালে তৎকালীন বরিশালের রায়বাহাদুরের স্টেট থেকে স্থানীয় কচা ও পোনা নদীর জলকারের দায়িত্ব পান মমিন উদ্দিন আকন।
মমিন উদ্দিন আকনের নাতি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ 'মমিন মসজিদ : স্মৃতি বিস্মৃতির কথা' গ্রন্থে  বলেছেন, ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার ছেলে বাদশা মিয়ার অনুসারী ছিলেন মমিন উদ্দিন আকন। নিজ বাড়িতে কাঠ দিয়ে মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এ লক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে  কাঠের নানা নকশা দেখে নিজেই সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। স্বজনদের আর্থিক সহায়তায় ১৯১৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়।
সে সময়ের বরিশাল অঞ্চলের কাঠশিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র পিরোজপুরের নেছারাবাদ (বর্তমানে স্বরূপকাঠি) থেকে তিনি হরকুমার নাথ নামে প্রসিদ্ধ এক মিস্ত্রিকে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে মসজিদ তৈরির কাজের দায়িত্ব দেন। ২২ জন মিস্ত্রি ৭ বছর ধরে কাজ করে ১৯২০ সালে শেষ করেন নির্মাণকাজ। মমিন উদ্দিন আকন সর্বদা মিস্ত্রিদের কাজ পরিচালনা করতেন এবং সূক্ষ্মভাবে কারুকাজ পরীক্ষা করে দেখতেন।
মসজিদ তৈরিতে ব্যবহৃত কাঠ মমিন উদ্দিন সংগ্রহ করেছিলেন মিয়ানমার, ত্রিপুরা ও আসাম থেকে। মসজিদের ফলকে এমন তথ্য খোদাই করা রয়েছে।
অন্যদিকে জনশ্রুতি রয়েছে, বাড়ি থেকে দূরের মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে কষ্ট হতো বলে যুবক মমিন উদ্দিন আকন নিজ বাড়িতেই মসজিদ নির্মাণের চিন্তা করেন। দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন মসজিদ পরিদর্শন শুরু করেন। প্রথমে ইট দিয়ে মসজিদ নির্মাণের চিন্তা করলেও পরে কাঠ দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা করেন। মসজিদটির কাঠামো ও আকার এ জনশ্রুতির পক্ষেও কথা বলে।


মমিন মসজিদের সৌন্দর্যকাহন:

বিশ্বব্যাপী এটি প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে মমিন মসজিদ নামে পরিচিত হলেও স্থানীয়ভাবে সবাই 'কাঠ মসজিদ' নামেই চেনেন।
সারা বিশ্বে এ ধরনের মসজিদ আর নেই বলেই দাবি করলেন স্থানীয়রা। গুগল ঘেঁটেও জানা গেল, পুরো কাঠের তৈরি মসজিদ আর রয়েছে মাত্র ইরানের খোরাসানে। তবে সেটি বৃহৎ আকৃতির ও বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্ন। সে হিসেবে মমিন মসজিদ পৃথিবীর একক নিদর্শন।
মসজিদটি তৈরিতে শুধু শাল, সেগুন ও লোহা কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। আনুমানিক ১২ ফুট প্রস্থ ও ২৪ ফুট দৈর্ঘ্যের মসজিদটির প্রতিটি ইঞ্চি অনন্য নকশা করা। তবে মজবুত ও টেকসই এ মসজিদের কাঠামো তৈরিতে লোহার কোনো পেরেক ব্যবহার করা হয়নি। পরিবর্তে কাঠের শলা ব্যবহার করা হয়েছে।
মসজিদটিতে চৌচালা টিন শেড দিয়ে পাটাতন তৈরি করা হয়েছে। ভেতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পাটাতনের মাঝে তৈরি করা হয়েছে দ্বিতীয় আর একটি দোচালা টিনের ছাউনি। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি করে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে চারটি করে জানালা। পূর্ব দিকে একটি মাত্র প্রবেশদ্বার। তাতে কারুকার্যখচিত দুটি খাম্বা। খাম্বায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম। প্রবেশদ্বারের ওপরে বাঁ দিকে আরবি হরফে ক্যালিওগ্রাফিতে ইসলামের চার খলিফার নাম ও মাঝখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর নাম অলংকৃত করা হয়েছে। প্রবেশদ্বারের মাঝামাঝি অংশে খোদাই করা ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। ভেতরে মেহরাবের উপরও রয়েছে দারুণ ক্যালিওগ্রাফি।
পুরো ঘর তৈরিতে জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার এবং কাঠের ওপর আরবি ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে মমিন মসজিদের এ নির্মাণশৈলীই একে বিশ্বে একক ঐতিহ্যে পরিণত করেছে। কাঠের কারুকাজের অনন্য উদাহরণ এটি। যা ইন্দো-পারসিক আর ইউরোপীয় ধারার মিশেলে সৃষ্ট জগদ্বিখ্যাত স্থাপত্য। এতে টুকরো টুকরো কাঠ শিল্পকর্মের জ্যামিতিক বিন্যাসে গড়ে তোলা হয়েছে অনুপম নৈসর্গ। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে  হরেক ফুল, ফুলদানি ও ফলের নকশার সমন্বয়ে দেশীয় লোকজ উপাদান। এসব কারুকাজে ব্যবহার করা হয়েছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রং। যা এর আরেক অনন্য দিক।

মমিন মসজিদের ঐতিহ্য ও গুরুত্ব:

কাশ্মীরে একই বৈশিষ্ট্যের কাঠের একটি মসজিদ একসময় থাকলেও তা এখন আর নেই। ইরানের খোরাসান প্রদেশের কাঠ মসজিদটিও ১৯৪৬ সালে নির্মিত। সে হিসেবে মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদ বিশ্বের বিশেষ প্রাচীন প্রত্নসম্পদ। নির্মাণশৈলী, অভিনবত্ব আর স্থায়ীত্বের বিবেচনায় যেটি অনায়াসে বিশ্ব ঐতিহ্য হওয়ার যোগ্য।
এর ঐতিহাসিক ও প্রত্নমূল্য বিবেচনা করে ২০০৩ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিপ্ততর এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু আদতে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। কেবল মসজিদের সামনে ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা একটি নোটিশ ছাড়া।
মমিন মসজিদ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ৩০টি শিল্পসম্পৃদ্ধ মসজিদের মধ্যে অন্যতম বলে ইউনেসকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ইউনিসেফ প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম মসজিদ নিয়ে প্রকাশিত ৪০০ পৃষ্ঠার এক গ্রন্থে মমিন মসজিদের সচিত্র বর্ণনা রয়েছে। সম্পূর্ণ কাঠের নির্মিত কারুকার্য ও কোরিওগ্রাফি খচিত এই মসজিদটিতে কোনো ধরনের লোহা বা তারকাঁটা ব্যবহার করা হয়নি। বাংলাদেশের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত মসজিদের মধ্যে যেগুলো বেশি গুরুত্ব বহন করে, সেসব মসজিদের ছবি জাতীয় জাদুঘরেও প্রদর্শিত হয়। মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদের কয়েকটি বণর্ণনাসহ আলোকচিত্র জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

যাতায়াত:

মমিন মসজিদ দেখতে  লঞ্চ, বাস বা যেকোনোভাবে আসতে পারেন মঠবাড়িয়ার তুষখালীতে।পিরোজপুরের  শহরের পুরান বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় ছেড়ে যায় মঠবাড়িয়াগামী বাস। ৬০ টাকা ভাড়ায় পথে কচা নদীতে একটি ফেরি পেরিয়ে নামতে হবে তুষখালী বাজার। পিরোজপুর থেকে তুষখালী আসতে সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। তুষখালী বাজার পেরিয়ে তুষখালী হাইস্কুলের সামনে থেকে অটোরিকশা বা রিকশা করে সরাসরি বুড়িরচর গ্রামের কাঠ মসজিদ। এতে সময় লাগবে ১৫ মিনিট আর ভাড়া অটোরিকশায় জনপ্রতি ১০ আর রিকশায় ২০ টাকা।

Comments

Popular posts from this blog

পিরোজপুর সদরের কিছু উল্লেখযোগ্য মজাদার খাবার ও খাবারের স্থানের নাম

১.আইচ পুরি ভান্ডার এর পুরি।দামুদার ব্রীজের ঠিক এক পাশেই ছোট্ট করে এই পুরির দোকান  । অনেক জায়গায় পুরি খেলেও এটাকে আপনার বেস্ট বলতে হবে কারন ডাল পুরিতে অনেক ডাল এবং আলু পুরিতে অনেক আলু দেয়।  সন্ধ্যার পর ভরপুর গরম গরম পুরি খাওয়ার লাইন‌ লাগে এই দোকানে । প্রতিটা পুরি মাত্র ৫ টাকা। যে পরিমাণ আলু,ডাল ‌ঠুসায় সেই তুলনায় দাম কমই বলা চলে।ট্রাই করতে পারেন কোন এক সন্ধ্যায় । ২.সিও অফিস, ডাচ বাংলা বুথের পাশের চায়ের দোকানের গরুর দুধের চা। ৩.জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটে অবস্থিত ক্যাফে স্ট্রিট ফুড এর মালাই চা।পরিবেশন স্টাইল দারুন।দাম মাত্র ১৫ টাকা। ৪.দুলালের দধি ভান্ডারের রসগোল্লা, রসমালাই, দধি। ৫.ভাই ভাই মিস্টির দোকানের রসগোল্লা,দধি,রসমালাই। ৬.বেকুটিয়া ফেরিঘাটের রাস্তার পাশের ঝাল মুড়ি। ৭.পিরোজপুর পুরান বাসস্ট্যান্ডে খুলনা বাস কাউন্টারের পাশে দোকানের চিতই পিঠা।পিঠার সাথে মরিচ ভর্তা আর সরিষা ভর্তাটা জোশ লাগে। ৮.শেরে বাংলা মার্কেট এর বিপরীতে স্টার হোটেলে হট কফি। ৯.সিও অফিসের ওখানে ক্যাফে আল মদিনার চকলেট হট কফি,চকলেট কোল্ড কফি । দাম ৫০-৬০ টাকার মত লিখেছেন :জি,এম-আদল

পিরোজপুর জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

    লিখেছেন : জি,এম-আদল পিরোজপুর বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা।প্রকৃতি তার নিজ সাজে অপরুপ সৌন্দর্যে পিরোজপুর জেলাকে সাজিয়েছেন। নদীবিধৌত জেলা পিরোজপুরে রয়েছে সেরা কিছু দর্শনীয় স্থান।পিরোজপুর সদর, ইন্দুরকানি, নাজিরপুর, কাউখালী, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়ীয়া, নেছারাবাদ এই সাতটি উপজেলা নিয়ে পিরোজপুর জেলা গঠিত। এই উপজেলাগুলোর প্রায় প্রতিটি উপজেলারই রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভাসমান পেয়ারা হাট, কবি আহসান হাবিব এর পৈত্রিক ভিটা,রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি,হরিনপালা রিভারভিউ ইকো পার্ক, ভান্ডারিয়া শিশু পার্ক,ভান্ডারিয়া মিয়া বাড়ি মসজিদ,মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদ, পিরোজপুর এর ডিসি পার্ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।  ভাসমান পেয়ারা হাট : পিরোজপুর জেলার স্বরুপকাঠি উপজেলার আটঘর,কুরিয়ানা নামক জায়গায়  নৌকায় করে এই (Floating Market) ভাসমান পেয়ারা হাট বসে। কবি আহসান হাবিব এর পৈত্রিক ভিটা: কবি আহসান হাবীব একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ভাষার অন্যতম একজন খ্যাতনামা কবি।  আহসান হাবীব এর জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি,পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা গ্রামে

পিরোজপুর জেলা নামকরণের ইতিহাস

পৃথিবী সৃষ্টির পিছনে যেমন ইতিহাস রয়েছে ঠিক তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি দেশ,বিভাগ,জেলা ও এলাকা সৃষ্টির পিছনে রয়েছে হাজারো গল্প ও ইতিহাস। তেমনি পিরোজপুর জেলা সৃষ্টি ও নামকরণের পিছনেও রয়েছে নানা গল্প ও ইতিহাস। গবেষকদের মতে,আজকের এ পিরোজপুর সুলতানি আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চল পরিচিতি ছিল ফিরোজপুর নামে। মোগল সম্রাট শাহসূজার অকাল প্রয়াত পুত্র ফিরোজশাহের নামে 'ফিরোজপুর' এবং পরে অপভ্রংশ হিসেবে 'পিরোজপুর' নামকরণ হয়েছে। নাজিরপুর উপজেলার শাখারী কাঠির জনৈক হেলালউদ্দীন মোঘল নিজেকে মোঘল বংশের শেষ বংশধর হিসেবে দাবী করেছিলেন। তাঁর মতে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার নিকট পরাজিত হয়ে বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে এসেছিলেন এবং আত্মগোপনের এক পর্যায় নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর পারে একটি কেল্লা তৈরি করে কিছুকাল অবস্থান করেন। মীর জুমলার বাহিনী এখানেও হানা দেয় এবং শাহ্ সুজা তার দুই কন্যাসহ আরাকানে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি অপর এক রাজার চক্রান্তে নিহত হন। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী  এক শিশু পুত্রসহ থেকে যায়। পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করে ধীরে