Skip to main content

ছোটগল্প: ফেরার পরে


লিখেছেন: আশিক মাহমুদ রিয়াদ 

১.
রান্নাঘর থেকে চেচাচ্ছেন রহিমা খাতুন। বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছেন আসগর সাহেব।ঘরে বসে খাটের কোনে বসে পায়ে আলতা দিচ্ছিলো নীলু । 
শফিক বসে আছে বারান্দার টুলে,সকালের এক ফালি রোদ এসে পড়েছে তার পায়ের কাছে৷ এখন শীতকাল তাই রোদ ভালো লাগছে শফিকের। 
রহিমা খাতুন চেচাচ্ছেন আর বাসন-কোসন নাড়াচাড়া করছেন। বাসন-কোসন এবং চেচামেচিতে বিরক্ত হচ্ছেন আসগর সাহেব। তিনি একটু পর পর পত্রিকার পাতা থেকে চোখ সরিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছেন।আবার পত্রিকা চোখ বোলাচ্ছেন।আসগর সাহেব শফিককে বলছে, 'তোর মামিকে চেচামিচি থামাতে বলতো।আসগর সাহেব আবার পত্রিকায় মন দিলেন। শফিক কৌতূহলী হয়ে বসে রইলো। এতক্ষণ তার মাথায় কোন চিন্তা ছিলো না, কিন্তু এখন নতুন চিন্তা উদয় হয়েছে। নতুন চিন্তা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে তার মামা। শফিক ভাবছে তার মামিকে চেচামিচি থামাতে বলবে কি না। শফিক একবার তার মামার দিকে এবং পরে রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছে। তার মুখ জুড়ে রাজ্যের কৌতূহল। 

আসগর সাহেব দারুন বিরক্ত হয়ে শফিককে ধমক দিলেন। ধমকে রান্নাঘর থেকে রহিমা খাতুনের চেচামিচি থেমে গেলো। শফিক আচমকা ধমক খেয়ে নির্বিকার হয়ে বসে রইলো। এবার রান্নাঘর থেকে আরো বেশি করে চেচামিচি শুরু করলেন রহিমা খাতুন। আসগর সাহেবও পাল্টা জবাব শুরু করলেন। 

এতক্ষণ গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছিলো আর পায়ে আলতা দিচ্ছিলো নীলু। বাবা-মায়ের বাক যুদ্ধে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো নীলুর। বেখেয়াল বসত হাতের স্পর্শে আলতার বোতল পড়ে গেলো মেঝেতে। মেঝেতে আলতা গড়াচ্ছে। লাল রঙা হয়ে গেছে মেঝে। যেন রক্ত,কেউ রক্তাক্ত হয়েছে। নীলুর ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। নীলু ঘর থেকে বেরিয়ে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে রাগী গলায় কথা বলে আবার ঘরের ভেতরে চলে এলো। নীলুর ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। আলতা গড়িয়েছে মেঝেতে। নীলুর চোখে গড়িয়েছে জল।
২.
 সড়ক দূর্ঘটনায় শফিক তার বাবা মাকে হারায়। তখন শফিকের সাত বছর বয়স। শফিকের আশ্রয় হয় তার মামার বাড়িতে। আসগর সাহেব তার ভাগ্নেকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেন। ছোটবেলা থেকে শফিককে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছেন। শফিককে লেখাপড়া করিয়েছেন। কোন কিছুতে কমতি করেননি। 

শফিক লেখাপড়া শেষ করেছে এলাকার কলেজ থেকে। চাকরী পাচ্ছে না বেচারা।চাকরীর জন্য চেষ্টাও করেছে।ঢাকায় গিয়েছে, কিন্তু চাকরী জোগাড় করতে পারেনি। 

সেদিন বিকেল বেলায় শফিক বাজার থেকে নীলুর জন্য আলতা আর কাচের চুড়ি নিয়ে এলো। নীলুর মন খারাপ কেটে গেলো।নীলু ঠোট কেটে শফিককে বলল,'এসব আনার কি দরকার ছিলো? আপনি টাকাগুলো জমিয়ে আপনার প্রেমিকাকেই কিছু কিনে দিতে পারতেন'। গভীর রাতে নীলু ডায়েরি খুলে বসলো। নীলু লিখছে-

'শফিক ভাই! আপনাকে ধন্যবাদ। জানেন আপনি যখন আজ আমার জন্য আলতা আর কাচের চুড়ি নিয়ে এলেন। আমি দারুন খুশি হয়েছি।আপনি জানেন আপনার জন্য আমার অন্য এক অনূভুতি হয়। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার না। আপনি জানেন আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।আপনার গালে যখন খোচা খোচা দাড়ি উঠে তখন আপনাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে? শফিক ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি। ' 

নীলু ডায়েরি লেখার পরে বেশ কিছুক্ষণ ডায়েরি পড়লো।লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেলো। সে ডায়েরির লেখা কেটে দিলো। 

শফিক খাতা পত্র উল্টাচ্ছিলো। কোথায় যে রেখেছে টাকা গুলি সেগুলোর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।শফিক ক্ষীণ গলায় বলল,'ধুর! আজকাল কোথায় যে কি রাখি। শফিক বইপত্র উল্টাতে উল্টাতে একটা খাম পেলো। তড়িঘড়ি করে খামটি খুললো। ভেবেছিলো এটার বোধয় টাকার খামছিলো। শফিক চিঠিটা ফেলে দিলো। একপর্যায়ে শফিক টাকাগুলো পেলো। কিছুক্ষণ পরে শফিকের খেয়াল এলো একটা চিঠি পড়ে আছে মেঝেতে।শফিক চিঠিটি মেঝে থেকে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো,শফিকের দুজোড়া ভুরু কুচকে আছে। 

নীলু কলেজ থেকে ফিরে এসে হণ্যে হয়ে ডায়েরি খুজছে। কিন্তু তার ডায়েরি খুজে পাচ্ছে না। বিছানা উল্টাচ্ছে, বালিশ উল্টাচ্ছে। তবুও পাওয়া যাচ্ছে না ডায়েরিটা। 

৩.
বাজার থেকে ফিরেছে শফিক। সে দারুন ক্লান্ত। বাজারের ব্যাগ রান্না ঘরে দিয়ে শফিক তার নিজের ঘরে চলে গেলো৷ নীলুর ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। নীলু তার ঘরে বসে ডায়েরি লিখছি।যেসব কথা কাউকে বলা যায় না, সেসব কথা নীলু ডায়েরির পাতায় তুলে রাখে৷ এতে সে দারুন আনন্দ পায় ৷

সকাল হয়েছে! মোরগ ডাকছে। কুয়াশায় মাখা চারপাশ। বেলা বাড়লো৷ শফিককে ঘরে পাওয়া গেলো না। 


জীবনে অনেক কথা থাকে যেগুলো লেখা যায় না,কিংবা কাউকে বলাও যায় না৷ খুব কাছের কেউ? বাবা,মা কিংবা বউ৷ এই কথা কাউকে বলা যায় না। এই না বলা কথা একসময় পোড়ায়। ভেতরটা পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেয়৷ মাঝরাতে যেমন ক্ষুনপোকা কটরকটর করে কাঠ কাটে৷ ঠিক তেমনি জীবন বিরহের পোকাগুলোও সময় কেটে নেয়,রাত জাগায়,চোখের নিচে কালি ফেলে দেয়। এই কথা কাউকে বলা যায় না,তিলে তিলে জ্বলতে হয়। এই কথা খুব গোপন৷ খুব খুব খুব গোপন। নীলু এই কথাগুলো ডায়েরিতে লিখলো। লিখে আবার কেটে দিলো। পৃষ্ঠা ছিড়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলো। 
টিনের চালে টপ,টপ শিশির ফোটার আওয়াজ। নীলুর চোখ থেকে জল গড়ালো। 

দুদিন পার হয়ে গেলো শফিককে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। এভাবে কেটে গেলো কতদিন। 


পাঁচ বছর পরের ঘটনা,নীলুদের বাড়ির সামনে একটি সাদা রংয়ের প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে।সন্ধ্যে হয়েছে। মশাদের দল ভন ভন আওয়াজ শুরু করেছে। নীলু বসে আছে খাটের কোনে। পায়ে আলতা দিচ্ছে। হঠাৎ নীলুর মা নীলুর ঘরে এসে নীলুকে ডাক দিলো। নীলু আচমকা চমকে গেলো। হাতের ধাক্কায় আলতার রঙ মেঝেতে গড়ালো। 

নীলুর মা নীলুকে বলল,'ও নীলু শোন! দেখে যা কে এসেছে!" নীলু আলতা মাড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো মেঝেতে পায়ের লাল রঙা ছাপ পড়ে রইলো  মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বলল, 'শফিক ভাই! ' 

পাঁচ বছর পরে শফিক আবার বাড়িতে ফিরে আসে। শফিক সেদিন নীলুর ডায়েরিটা শফিক তার ঘর থেকে নিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলো। শফিক চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় চলে আসে। 

আজ পাঁচ বছর পর শফিক বাড়িতে ফিরে এলো।শফিক শুধু একা ফেরেনি  শফিকের সাথে ফিরেছে শফিকের বিবাহীত স্ত্রী এবং তাদের সন্তান। 

শফিক তার মামার খাটের কোনে বসে আছে৷ শফিকের স্ত্রী তার মামীর সাথে রান্না ঘরে সাহায্য করছে৷ শফিকের ছেলে তার মামার কোলে হুটিপুটি করছে। আসগর সাহেব আজ দারুন খুশি। 

 নীলু তার ঘরে বসে আছে সন্ধ্যে মিলিয়ে আসছে। নীলু কদম ফুলের ঘ্রান পাচ্ছে। এখন শীতকাল, কদম ফুল ফোটার কথা না৷ তবুও পাচ্ছে,নীলুর চোখ ভীজে আসছে৷ সে কাঁদছে নিরবে নিভৃতে।

Comments

Popular posts from this blog

পিরোজপুর সদরের কিছু উল্লেখযোগ্য মজাদার খাবার ও খাবারের স্থানের নাম

১.আইচ পুরি ভান্ডার এর পুরি।দামুদার ব্রীজের ঠিক এক পাশেই ছোট্ট করে এই পুরির দোকান  । অনেক জায়গায় পুরি খেলেও এটাকে আপনার বেস্ট বলতে হবে কারন ডাল পুরিতে অনেক ডাল এবং আলু পুরিতে অনেক আলু দেয়।  সন্ধ্যার পর ভরপুর গরম গরম পুরি খাওয়ার লাইন‌ লাগে এই দোকানে । প্রতিটা পুরি মাত্র ৫ টাকা। যে পরিমাণ আলু,ডাল ‌ঠুসায় সেই তুলনায় দাম কমই বলা চলে।ট্রাই করতে পারেন কোন এক সন্ধ্যায় । ২.সিও অফিস, ডাচ বাংলা বুথের পাশের চায়ের দোকানের গরুর দুধের চা। ৩.জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটে অবস্থিত ক্যাফে স্ট্রিট ফুড এর মালাই চা।পরিবেশন স্টাইল দারুন।দাম মাত্র ১৫ টাকা। ৪.দুলালের দধি ভান্ডারের রসগোল্লা, রসমালাই, দধি। ৫.ভাই ভাই মিস্টির দোকানের রসগোল্লা,দধি,রসমালাই। ৬.বেকুটিয়া ফেরিঘাটের রাস্তার পাশের ঝাল মুড়ি। ৭.পিরোজপুর পুরান বাসস্ট্যান্ডে খুলনা বাস কাউন্টারের পাশে দোকানের চিতই পিঠা।পিঠার সাথে মরিচ ভর্তা আর সরিষা ভর্তাটা জোশ লাগে। ৮.শেরে বাংলা মার্কেট এর বিপরীতে স্টার হোটেলে হট কফি। ৯.সিও অফিসের ওখানে ক্যাফে আল মদিনার চকলেট হট কফি,চকলেট কোল্ড কফি । দাম ৫০-৬০ টাকার মত লিখেছেন :জি,এম-আদল

পিরোজপুর জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

    লিখেছেন : জি,এম-আদল পিরোজপুর বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা।প্রকৃতি তার নিজ সাজে অপরুপ সৌন্দর্যে পিরোজপুর জেলাকে সাজিয়েছেন। নদীবিধৌত জেলা পিরোজপুরে রয়েছে সেরা কিছু দর্শনীয় স্থান।পিরোজপুর সদর, ইন্দুরকানি, নাজিরপুর, কাউখালী, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়ীয়া, নেছারাবাদ এই সাতটি উপজেলা নিয়ে পিরোজপুর জেলা গঠিত। এই উপজেলাগুলোর প্রায় প্রতিটি উপজেলারই রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভাসমান পেয়ারা হাট, কবি আহসান হাবিব এর পৈত্রিক ভিটা,রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি,হরিনপালা রিভারভিউ ইকো পার্ক, ভান্ডারিয়া শিশু পার্ক,ভান্ডারিয়া মিয়া বাড়ি মসজিদ,মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদ, পিরোজপুর এর ডিসি পার্ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।  ভাসমান পেয়ারা হাট : পিরোজপুর জেলার স্বরুপকাঠি উপজেলার আটঘর,কুরিয়ানা নামক জায়গায়  নৌকায় করে এই (Floating Market) ভাসমান পেয়ারা হাট বসে। কবি আহসান হাবিব এর পৈত্রিক ভিটা: কবি আহসান হাবীব একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ভাষার অন্যতম একজন খ্যাতনামা কবি।  আহসান হাবীব এর জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি,পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা গ্রামে

পিরোজপুর জেলা নামকরণের ইতিহাস

পৃথিবী সৃষ্টির পিছনে যেমন ইতিহাস রয়েছে ঠিক তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি দেশ,বিভাগ,জেলা ও এলাকা সৃষ্টির পিছনে রয়েছে হাজারো গল্প ও ইতিহাস। তেমনি পিরোজপুর জেলা সৃষ্টি ও নামকরণের পিছনেও রয়েছে নানা গল্প ও ইতিহাস। গবেষকদের মতে,আজকের এ পিরোজপুর সুলতানি আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চল পরিচিতি ছিল ফিরোজপুর নামে। মোগল সম্রাট শাহসূজার অকাল প্রয়াত পুত্র ফিরোজশাহের নামে 'ফিরোজপুর' এবং পরে অপভ্রংশ হিসেবে 'পিরোজপুর' নামকরণ হয়েছে। নাজিরপুর উপজেলার শাখারী কাঠির জনৈক হেলালউদ্দীন মোঘল নিজেকে মোঘল বংশের শেষ বংশধর হিসেবে দাবী করেছিলেন। তাঁর মতে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার নিকট পরাজিত হয়ে বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে এসেছিলেন এবং আত্মগোপনের এক পর্যায় নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর পারে একটি কেল্লা তৈরি করে কিছুকাল অবস্থান করেন। মীর জুমলার বাহিনী এখানেও হানা দেয় এবং শাহ্ সুজা তার দুই কন্যাসহ আরাকানে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি অপর এক রাজার চক্রান্তে নিহত হন। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী  এক শিশু পুত্রসহ থেকে যায়। পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করে ধীরে